অনু গল্প

একটি ভোরের গল্প

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-অরণ্য আন্ওয়ার

বিছানায় শুয়েই দেখছিলাম চারপাশের অন্ধকার তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে। আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। তখনও নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি আমার দেহমন জুড়ে। তবুও নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে রাস্তায় নেমেই পড়লাম। আমার ভাবখানা এমন ছিল যে, যেন হাঁটতে হাঁটতে পৃথিবীর বাইরের কোন স্টেশনে চলে যাব।

বকুলতলা মোড় ধরে ব্রহ্মপুত্র নদীর দিকে যাচ্ছিলাম। দেখি, বেশ কিছু গাছের নিচে ঝরা ফুল বিছিয়ে আছে। কয়েকটা ফুল হাতে তুলে কাছে আনতেই মনে হলো, এ ফুলগুলো কখনো ভোর দেখে না। রাতে ফুটে রাতেই ঝরে যায়। ফুলটার নাম আমার জানা নেই। অথবা শুনেছিলাম, হয়তো ভুলে গেছি। ইদানিং আমি অনেক কিছুই খুব দ্রুত ভুলে যাই। যতটুকু মনে পড়ে, শৈশবে আমরা এই ফুল কুড়াতাম শীতকালের কোন ভোরে। হায়রে ফুলের জীবন!! কত ক্ষণিক সময়ের। মহাকালের অনন্ত সময়ের তুলনায় আমার জীবনের যে আয়ুষ্কাল, সেটাও তো ফুলের জীবনের মতো ক্ষণিক সময়ের ।

শুনছিলাম, কয়েকটা কাক বৈদ্যুতিক তারে বসে আত্মা ছেড়ে সুর তুলছে। কোন কষ্টে যে কাকেরা এভাবে আর্ত্বনাদ করে, কে জানে। আমার ভেতরটা ফাকা হয়ে যায়। আরও কিছু দূর হেঁটে যেতেই শুনি, নিচু গলায় একটা ঘুঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করছে। আরও আছে দোয়েল, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনি চড়ুইসহ নাম না জানা অনেক পাখির গানের আসর। দূরে ধবধবে সাদা বক কমে আসা ব্রহ্মপুত্রের পানিতে মাছের ইজারা নিয়েছে যেন।

প্রায় প্রতিদিনই অনেক লোক এই নদীর পাড়ে ঘুরতে আসে। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হলে চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চ গুলোতে বসে। উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ক্লান্তি ভুলে। এখানে ব্রহ্মপুত্রের জল ছুঁয়ে আসা বাতাস আর বুনো ফুলের এক ধরনের আদিম গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতেই হঠাৎই চোখ গেল কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চিরচেনা কড়ই গাছটার দিকে। তার গা ছুঁয়ে মনে হলো, শিল্পীর কাঠ খোদাই করা ভাস্কর্য যেন। প্রাচীন এই গাছটার বাকলের ফাঁকে ফাঁকে কত মায়া জড়িয়ে আছে। গাছের গায়ের থেকে হাত সরাতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে গাছটা বলল, ” আমাকে তোমার সাথে নেবে? ”

বুঝলাম, গাছেরাও যে ভালবাসা বোঝে, তা হয়তো কোন কোন মানুষও বোঝেনা।

ভাবলাম, বাসায় ফেরা দরকার। রোদ উঠে গেলে আর ভালো লাগবে না।

ফিরতি পথে শুনি , একটা কুকুর কি যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। গোঙানির মতো একটা আওয়াজ শোনা যায় তার। পেছন ফিরে দেখি কেউ নেই, কিছু নেই। দোকান থেকে একটা পাউরুটি কিনে ওর মুখের কাছে ছুড়ে দিতেই লুফে নিল সেটা। যদিও আমি কুকুর দেখলে ভয় পাই, তবুও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। দেখি, কুকুরটা আমার পেছনে পেছনে আসছে। কি যে মায়া হলো কুকুরটার প্রতি। একটা কুকুরও যে মায়া বোঝে, একটা মানুষও অনেক সময় সে মায়াটা বোঝেনা।

এবার আমাকে যেতেই হবে। কুকুরটা আমার পিছু নিয়েছে। আর কড়ই গাছটারও দেখি খুব মন খারাপ। ভোরের পশু – পাখি, গাছপালা আর শীতল বাতাসের এত ভালবাসা আমি একা নিতে পারছি না। পাশে এমন কেউ ছিল না, যাকে সে ভালবাসার ভাগ দিতে পারি।

Add Comment

Click here to post a comment

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031