ইতিহাস-ঐতিহ্য

বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে বুড়িগঙ্গায় যেভাবে ডুবে মরলেন ঘসেটি বেগম

মতিঝিল প্রাসাদ

হ্যালোডেস্ক

যথাসময়ে মতিঝিল প্রাসাদের সামনে গিয়ে থামলো সিরাজ-বাহিনী। ধীরে ধীরে ঘেরাও হয়ে গেলো প্রাসাদ। চারদিকেই একটা থমথমে ভাব, এই বুঝি যুদ্ধ লেগে যায় ভাগনে আর খালার বাহিনীর মাঝে। খবর গেলো ঘসেটি বেগমের কাছে, তাকে বন্দী করা হবে। এক নবাবের কন্যা তিনি (নবাব আলিবর্দী খাঁ), ফলে নবাবী বৈশিষ্ট্য তিনিই বা কম দেখাবেন কেন! তাই তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিরোধের।

ওদিকে ঘসেটি বেগমের খাস মুন্সির নাম ছিল মীর নজর আলী। অর্থ দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তারই। তিনি বুঝলেন, সিরাজ-বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘসেটি-বাহিনী কোনো প্রতিরোধই গড়তে পারবে না। তাসের ঘরের মতোই ভেঙে যাবে তাদের প্রতিরোধের যাবতীয় প্রচেষ্টা। ফলে অযথা সাধের প্রাণটা হারাতে চাইলেন না তিনি। চুপ করে কিছু অর্থকড়ি নিজে রেখে বাকিগুলো ঘসেটি বেগমের সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে সবাইকেই উপদেশ দিলেন পালিয়ে যেতে! ঘসেটি বেগমের মূল্যবান অলঙ্কারাদি ও নগদ অর্থ এভাবেই হাতবদল হয়ে গেলো, আর পতনও ঘটলো মতিঝিল প্রাসাদের।

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের ছেলে মিরন চাইছিলেন নবাব আলিবর্দীর সর্বশেষ জীবিত দুই তনয়া ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকে (সিরাজদ্দৌলার মা) দুনিয়া থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে। এজন্য তিনি দুজন লোক পাঠিয়েছিলেন জেসারত খাঁর উদ্দেশ্যে, যাতে করে তিনি এ বিষয়ে একটি ব্যবস্থা নেন। কিন্তু জেসারত খাঁর আবার নবাব আলিবর্দীর প্রতি ছিল কৃতজ্ঞতার সুদীর্ঘ ইতিহাস। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ভারতবর্ষে আসলেও তেমন সুবিধা করতে না পেয়ে ভগ্নমনোরথে রাস্তার পাশেই মাথা গোজার ঠাই করে নেন তিনি, শারীরিকভাবেও ছিলেন বেশ অসুস্থ। সেখান থেকে নবাব আলিবর্দী জেসারতকে নিজ প্রাসাদে এনে আশ্রয় দেন। চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। নিজের কাছে রেখেই তাকে রাজকার্য শেখাতে থাকেন। পরে নিজ গুণে কালক্রমে ঢাকার নায়েবে নাজিম হন জেসারত খাঁ। তাই আলিবর্দীর কোনো তনয়ার প্রতিই এতটা নির্মম হতে পারেননি তিনি, ফিরিয়ে দিলেন মিরনের দুই দূতকে।

নবাব আলিবর্দী খাঁ

এতে করে মিরন বুঝে গেলেন যে, জেসারত খাঁ তার কিংবা তার বাবার মতো নেমকহারামি করার মানুষ না! তাই তিনি নতুন করে দায়িত্ব দিলেন তার বিশ্বস্ত অনুচর আসফ খাঁকে। মিশন সেই আগেরটাই- ঘসেটি ও আমেনা বেগমের বিশ্বাসভাজন হয়ে তাদের খতম করে দেয়া।

দু’বোন তখন বুঝতে পারেন যে তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। আমেনা বেগম প্রাণভিক্ষা চাননি। তিনি কেবল সৃষ্টিকর্তার কাছে মিরনের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি চেয়ে দোয়া করেছিলেন। বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, তুমি মিরনের অপরাধী মস্তকের উপর বিনা মেঘে বজ্রপাত নিক্ষেপ করে বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার দিও।”

ওদিকে ঘসেটি বেগম অনেক অনুনয়-বিনয় করেন, অতীত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে তিনিও মীর জাফর আর মিরনের পক্ষেরই লোক। বলছিলেন, “মীর জাফর সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করায় ও সিরাজ তা জানতে পেরে পদচ্যুত করেছিল তাকে। ঐ দুঃসময়ে আমি মীর জাফরকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছি। মীর জাফরের কোনো ক্ষতি তো আমি করিনি।”

মীর জাফর (বামে) ও মীর মিরন

কিন্তু তার এসব আবেগপূর্ণ ও কান্নামাখা কথায় চিড়ে ভেজেনি। যাদেরকে তিনি এককালে রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি আপন বলে মনে করেছিলেন, তাদেরই পাতা ফাঁদে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাকে। অসহায়ভাবে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে যেন নিজের বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম ভোগ করলেন ঘসেটি বেগম।

আজকের বুড়িগঙ্গা। সংগৃহীত ছবি

আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন। হ্যালোটুডে’র ইতিহাস বিভাগে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখা পাঠাতে পারেন। হ্যালোটুডে আপনার মনের কথা বলে।

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031