ইতিহাস-ঐতিহ্য

পুরান ঢাকার আর্মেনিয়ান গির্জা: এক ঔপনিবেশিক স্মৃতি

হ্যালোডেস্ক

পুরান ঢাকার আরমানিটোলার পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রাচীন ইউরোপীয় ধাঁচের ফটকটি চোখে পড়বে। চারিদিকে এরোমেটিক পণ্যের সুগন্ধ, এলাকাটি পুরান ঢাকার রাসায়নিক পণ্যের আড়তে ভরা। ঘিঞ্জি রাস্তাঘাট আর ঠাসাঠাসি করে বেড়ে ওঠা বেমানান বাড়িঘরের মাঝে হঠাৎ করেই স্থাপনাটির ফটকে বড় করে লেখা ‘আর্মেনীয়ান চার্চ, ১৭৮১’ থমকে দেবে যে কাউকেই। ফরাসি বিপ্লবেরও আট বছর আগের একটা সাল দেখে কিছুটা অবিশ্বাসও দেখা দিতে পারে মনে। দু’শ ছত্রিশ বছর আগের একটা চার্চ? এরকম এক জায়গায়?

গির্জার প্রবেশমুখের নামফলক

আর্মেনিয়া দেশটি ইরান ও তুরষ্কের গা ঘেঁষে অবস্থান করা একটি রাষ্ট্র, যদিও প্রাচীনকালে এর ভৌগলিক সীমানা ছিল আরো বড়। ষোড়শ শতকে ইরান বা তৎকালীন পারস্যের সাফাভি শাসকেরা মধ্য এশিয়ায় তাদের আবাসভূমি আর্মেনিয়া জয় করার পর আর্মেনীয় সম্প্রদায় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাদের এ দেশে আগমনের কারণ ছিল একইসাথে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক।

গির্জায় প্রবেশের ফটক

ঠিক কবে আর্মেনীয়রা এ দেশে এসেছিলো তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। ফার্মগেটে অবস্থিত গির্জার প্রাঙ্গনে কয়েকজন আর্মেনীয়র কবর আছে। তাদের মৃত্যু হয়েছিলো ১৭১৪-৯৫ সালের মধ্যে। ফলে আন্দাজ করা যায়, মোগল আমলেই তারা এ দেশে আসতে শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে ভাগ্যান্বেষণ করা। সেসময় সেটা তারা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছিলো।

সেসময় মোগল সম্রাট আকবর ছিলেন ভারতের অধিপতি, তার অনুমতি সাপেক্ষে আর্মেনীয়রা ভারতে ব্যবসা-বাণিজ্য করা, বসতি স্থাপন ও গির্জা নির্মাণ করে। প্রথমদিকে তারা পশ্চিমবঙ্গের পাটনা, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা ইত্যাদি জায়গায় ব্যবসা ও বসতি গড়ে তোলে। এরপর ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় রাজধানী পত্তন করলে ধীরে ধীরে বিশ্বের বিভিন্ন জাতির লোকেরা ব্যবসার জন্য আসতে থাকে। যার মধ্যে আর্মেনিয়রা তো ছিলই, সাথে ছিল পর্তুগিজ, ডাচ, ফরাসি, গ্রিক, চীনা ইত্যাদি।

গির্জার মূল ঘরে প্রবেশ দরজার উপর বরাবর আছে ঘন্টার টাওয়ার

লোক সংখ্যায় আর্মেনিয়রা ছিল অল্পই, কিন্তু শহরে তারা ছিল বেশ প্রভাবশালী। ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রভাব আর অঢেল অর্থ সম্পদই তাদের প্রভাবের কারণ। অষ্টাদশ শতকে লবণ ব্যবসা ছিলো ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু লবণ উৎপাদন ও বিতরণের জন্যে ইংরেজরা ঠিকাদার নিয়োগ করত, যার অধিকাংশই ছিলেন আর্মেনীয়রা। ঠিকাদারি ছাড়াও কাপড়, পান ও পাটের ব্যবসায় আর্মেনীয়রা কর্তৃত্ব করত। এখানে উল্লেখ্য, এদেশে পণ্য হিসেবে পাটের উজ্জ্বল সম্ভবনা আর্মেনীয়রাই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন। পাটের ব্যবসাতেই তারা ছিলেন অগ্রগণ্য।

গির্জার চারপাশে ছড়ানো আছে অনেক কবর

ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির ফলে ঢাকায় আর্মেনীয়দের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তারা নিজেদের বসবাসের সুবিধার্থে বাড়িঘর তৈরী শুরু করে। ধীরে ধীরে ঢাকার ঐ এলাকাটি আর্মেনীয়দের একটি আবাসিক পাড়ায় পরিণত হয়। এর থেকেই এলাকাটির নাম হয়ে যায় আরমানিটোলা। আবাসিক বাড়িঘরগুলোর সবই ছিলো আর্মেনীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি, যার হাতে গোনা কয়েকটি এখনো মানুষের আগ্রাসী ‘উন্নয়ন’ এর সাথে লড়াই করে টিকে আছে। টিকে থাকার আরেকটা কারণ বোধহয় এটার পুরাকীর্তি হিসেবে নথিবদ্ধ তাই।

প্রথম দিকে ঢাকায় আগত আর্মেনীয়দের কবর তেজগাঁওয়ের ফার্মগেট গির্জা প্রাঙ্গনে পাওয়া যায়, ঐ সময় আর্মেনীয়রা আরমানিটোলায় একটি ছোট গির্জায় প্রার্থনা করত (এ ধরনের ছোট গির্জাকে বলে ‘চ্যাপেল’)। ১৭৮১ সালে একজন বিত্তবান আর্মেনীয় জমিদার নিকোলাস পোগজ (স্থানীয় মানুষের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন নিকি সাহেব নামে) ঐ ছোট গির্জার স্থলে বেশ কয়েক বিঘা জমির উপর বিশাল এক গির্জা নির্মাণ করেন। তিনি গির্জার নামকরণ করেন ‘চার্চ অব দ্য রিজারেকশন’।

যে জায়গায় এখন চার্চটি অবস্থিত, সেটি ছিল একটি কবরস্থান। সে কারণেই এখনও চার্চের বারান্দায় কিছু কবর দেখা যায়। গির্জা তৈরীর জন্য চারপাশের যে বিস্তৃত জমি আছে, তা দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক। এছাড়াও লোকশ্রুতি অনুসারে গির্জা নির্মাণে আরো চার ব্যক্তি সাহায্য করেছিলেন। তারা হলেন মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটাসেতুর সিভর্গ, আগা এমনিয়াস এবং মার্কার পোগজ।

আরমানিটোলার আগা-গোড়া সব আমূল পরিবর্তন হয়ে গেলেও একমাত্র গির্জাটিই তার আদিরূপ ধরে রেখেছে। যদিও আদিরূপের মধ্যে গির্জার ঘন্টার ধ্বনি আর প্রার্থনায় সমবেতদের গমগমে উপস্থিতি পাওয়া যাবে না। এটি এখন সবসময় বন্ধই থাকে। এছাড়াও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে গির্জার ঘড়িঘরটি ভেঙ্গে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে তা সংষ্কার করা হয়।

ইতিহাস অনেক ঘাঁটা হলো, এবার গির্জার বর্ণনার দিকে যাওয়া যাক। চমৎকার কারুকাজ করা ফটক পেরিয়ে প্রাঙ্গনে ঢুকে বাঁ হাতে গির্জাটি দাঁড়িয়ে। তবে যে জিনিসগুলো ঢুকেই প্রথমে নজর কাড়বে তা হলো গির্জার চারপাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কবর। প্রত্যেকটি কবরের উপরে মর্বেল পাথরে তৈরী এপিটাফ, যাতে প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু এবং মৃত ব্যক্তির সম্পর্কে কিছু স্মৃতিচারণমূলক কথা লেখা আছে।

অন্য সব কবরের থেকে একটা কবর বেশ আলাদা। কবরটি জনৈক ক্যাটচিক আভেটিক থমাসের, যিনি ১৮৭৭ সালে প্রয়াত হয়েছেন। কবরের এপিটাফে লেখা আছে
A fond wife’s tribute
To her deeply mourned
And best of husband.

এই একটিমাত্র কবরের উপরেই আছে একটি ‘ওবেলিস্ক’। কবরের উপরে বেদির মতো দেখতে স্তম্ভকে ওবেলিস্ক বলা হয়। ওবেলিস্কের উপরে রয়েছে মাদার মেরীর একটি চমৎকার মার্বেল পাথরে তৈরী ভাষ্কর্য, ভাষ্কর্যটির একটি হাত ভেঙ্গে গেছে কোনো দূর্ঘটনায়। মূর্তিটি থমাসের স্ত্রী এনেছিলেন কলকাতা থেকে।

ওবেলিস্কের উপরে মেরীর মূর্তি, এখানকার সবচেয়ে সুন্দর কবর এটি

গির্জাটি লম্বায় সাতাশ ফুট, প্রবেশের জন্যে আছে চারটি দরজা, জানালা আছে সাতাশটি। গির্জার তিনদিক ঘিরে রয়েছে বারান্দা। আর্চ সহ কলামের সারি রয়েছে চারদিকে। গির্জা ভবনের শেষ মাথায় আছে একটি ষড়ভূজ আকৃতির টাওয়ার। সমগ্র গির্জাটি সাদা রং করা, কলাম-রেলিং ইত্যাদির ধারগুলোতে হলুদ রং দিয়ে নকশা করা আছে।

গির্জার অভ্যন্তরের দৃশ্য

চার্চের ভেতরে প্রবেশ করলে সারি সারি বেঞ্চ নজরে পড়বে, এটা মূল প্রার্থনা কক্ষ। কক্ষের শেষ মাথায় আছে উঁচু বেদী। বেদির উপরে যিশুখৃষ্টের চিত্র ও ধাতব ক্রস রয়েছে। গির্জার প্রবেশ মুখে বাঁহাতে একটি পেঁচানো সিঁড়ি আছে দুই তলায় ওঠার জন্যে। দ্বিতীয় তলাটা অনেকটা গ্যালারীর মতো। এ অংশটি নারী ও শিশুদের জন্য সংরক্ষিত থাকত বলে ধারণা করা হয়।

সূর্য ঘড়ি, মাঝখানে একটি ত্রিকোণ অংশ ছিল যেটার ছায়া দিয়ে সময় নির্ধারণ হতো

পুরো গির্জা প্রাঙ্গন জুড়ে ছড়ানো কবরগুলোর এপিটাফ পড়তে পড়তে ফিরে যাওয়া যায় শত বছর আগে। আর্মেনীয় আর ইংরেজী ভাষা মেশানো এপিটাফগুলোতে স্বজনদের আবেগ উঠে এসেছে কিছু কাব্যিক ভাষায়, সেই সাথে অধিকাংশ এপিটাফে ধর্মগ্রন্থের বাণীও উদ্ধৃত রয়েছে। এপিটাফগুলো পাথরের তৈরী। শ্বেতপাথর, বেলেপাথর ও কষ্টি পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। পাথরগুলো কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে কেনা।

গির্জার সর্বশেষ ওয়ার্ডেন মাইকেল জোসেফ মার্টিন, যিনি বাংলাদেশে অবস্থান করা সর্বশেষ আর্মেনীয়ও বটে। পেছনে দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ডেনের বাসভবন। source: লেখক, মার্টিনের ছবিটি BBC থেকে প্রাপ্ত

কবরগুলোর মাঝে একটি ছোট বেদির উপর একটি সূর্য ঘড়ি আছে। তার ঠিক পাশেই ‘১৯২৯’ চিহ্নিত একটি বাড়ি যেটাতে চার্চের একজন কর্মী পরিবার সহ থাকেন। চার্চ প্রাঙ্গনের শেষ মাথায় একটি লাল ইটের প্রাচীন বাড়িতে চার্চের ‘ওয়ার্ডেন’ বা তত্ত্বাবধায়ক থাকতেন। মাইকেল জোসেফ মার্টিন এই চার্চের সর্বশেষ ওয়ার্ডেন, ২০০৫ সালে স্ত্রীর মৃত্যু হলে কানাডায় নিজ মেয়েদের কাছে পাড়ি জমালে ঢাকা চূড়ান্তভাবে আর্মেনীয়শূন্য হয়ে যায়।

শতবছর ধরেই নিরব হয়ে আছে গির্জার ঘন্টা, যার শব্দ এক সময় পুরো ঢাকায় শোনা যেত

গীর্জার ষড়ভূজ আকারের টাওয়ারের ভেতরে ছিল চার্চের বিখ্যাত ঘন্টা। বিখ্যাত বলার কারণ তৎকালীন ঢাকাবাসী, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, এই ঘন্টাই ছিল সময় গণনার একমাত্র উপায়। ১৮৮০ সালের দিকে আর্মেনীয়দের জৌলুশ যখন নিভু নিভু ব্যয় সংকোচনের জন্যে ঘন্টাবাদককে অবসর দেয়া হয়। তখন থেকে বন্ধ হয়ে যায় গির্জার নিয়মিত ঘন্টা ধ্বনি। এতে সেই বছর ঢাকার একটি সংবাদপত্র আক্ষেপ করে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলো। এরপর গত শত বছর ধরেই নিরবেই পড়ে আছে আর্মেনিয় গির্জাটি।

তথ্য: ইন্টারনেট

আমাদের সাথে যুক্ত থাকতে লাইক বাটনে ক্লিক করুন। হ্যালোটুডে’র ইতিহাস বিভাগে নিয়মিত লিখতে পারবেন আপনিও। আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন, আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখা দিয়ে। হ্যালোটুডে আপনার মনের কথা বলে।

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031