রকমারি

বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে ফেরিওয়ালাদের এখন আর দেখা যায় না গ্রাম বাংলায়

-মিলন মাহমুদ রবি

কালের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। সেখানে স্থান করে নিচ্ছে প্রযুক্তির কৃত্রিমতা। অনেক কিছুর মধ্যে বায়োস্কোপ তেমনই একটি হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য। হারানোর পথে গ্রাম বাংলার চিরচেনা এই ঐতিহ্য। যা এক সময় ছিল গ্রাম বাংলার শিশুদের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। গ্রাম বাংলার শিশু-কিশোরদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যমও ছিল এটি।

আগেকার দিনে গ্রাম-গঞ্জের যেখানে সেখানে হামেশা দেখা যেত বায়োস্কোপ। ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে সবাইকে আহবান জানাতো বায়োস্কোপ দেখার জন্য। এখন দশ গ্রাম ঘুরলেও দেখা মিলে না বাক্সবন্দী এ বিনোদনের। কালের বিবর্তনে ও আকাশপথ খোলা থাকার কারণে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের এই ঐতিহ্য। আধুনিক প্রযুক্তির দাপটে গ্রাম বাংলার মেলা ও হাট-বাজারে এখন আর বায়োস্কোপের দেখা মিলে না। গ্রাম বাংলার শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ একসময় বায়োস্কোপ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। বায়োস্কোপের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নানা ঐতিহ্যের স্থিরচিত্রের (ছবি) মাধ্যমে ইতিহাসের কথা জানতে পারত। বায়োস্কোপ দেখতে বায়না ধরত শিশু-কিশোররা। বায়োস্কোপের বাক্স কাঁধে ফেরিওয়ালা চেঁচিয়ে বলতেন, ‘বায়োস্কোপ দেখবেননি বায়োস্কোপ …।’ এ ধরনের শব্দ শুনে ছুটে আসত শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী লোক। বায়োস্কোপ দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো আনন্দ উপভোগ করতেন। আর বায়োস্কোপ প্রদর্শনকারী নেচে গেয়ে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী লোকদের আকৃষ্ট করতেন। প্রদর্শনকারীর কণ্ঠে থাকতো ‘এইতো দেখেন গোলাগুলি বাইজ্যা গ্যাছে, হাজার হাজার সৈন্য আছে, কত সৈন্য শহীদ হলো, ডানে-বামে লক্ষ্য করেন, এবারেতে দেখেন ভাল শহীদ মিনার কাছে আছে, এবারেতে দেখেন ভাল বঙ্গবন্ধুর ছবি আছে। এবারেতে দেখেন ভাল শেখ হাসিনা সামনে আছে, ইন্দিরাগান্ধী পাশে আছে, দেখেন কত বাহার আছে, এবারের দেখেন ভাল, কলকাতা শহর আছে, বড় লোকের বাড়ি আছে, হাইকোর্টের কাচারি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল আমেরিকা শহর আছে, এক শ’ তলা বাড়ি আছে। এই বাইরেতে দেখেন ভাল ভিষণ যুদ্ধ ব্যাইজা গ্যাছে, কত বিমান উড়া গেছে, কত বিমান পড়াই রইছে। এবারেতে দেখেন ভাল দিল্লীর শহর আছে। লন্ডন শহর দেখা যাচ্ছে, সারি সারি বিল্ডিং আছে, পাহাড় আছে, ঝর্ণা আছে, নবারের বাড়ি আছে, তামহল আছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার আছে। আর কত কি আছে, এবারেতে দেখেন ভাল ফাঁকা ময়দান পড়ে রইল…।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় গোটা বিশ্ব আর সারি সারি দালান কোঠার শহরে ঘেরা তেমনই এক শহর খুলনা। এ শহরে দেখা মিললো এক বায়োস্কোপ ওয়ালারা। নাম তার এম এস ইমরান। তিনি খুলনা শহর ঘুরে ঘুরে হারানো ঐতিহ্যকে জানান দিতে ছুটে বেড়ান এদিক ওদিক। তবে ইমরানকে অনেকে জাদু শিল্পী হিসেবে চেনেন। ইমরান জানান শহরের কোথায়ও মেলা হলে সেখানে স্টল নিয়ে জাদু খেলা দেখানোর পাশাপাশি বায়োস্কোপ খেলাও দেখান। বায়োস্কোপের প্রতি তার দুর্বলতা জানতে চাইলে বলেন, এটা অনেক পুরনো ঐতিহ্য হারানোর পথে প্রায় এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ভিন্ন কৌশলে উপস্থাপন করা। ইমরানের বায়োস্কোপের বাক্সটি আধুনিক কায়দায় করা। শিশুদের বিনোদন দিতে পারাটা তার জন্য আনন্দের। তার বাক্সের ভিতরে স্থিরচিত্রের (ছবি)তে বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীকসমূহ যেমন- ফুল, ফল, পাখিসহ নানান ধরনের ছবি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। এসব প্রতীক শিশুদের জানানোর জন্যই তার এমন কৌশল বলেও জানান তিনি। তবে তিনি এই বায়োস্কোপ খেলা দেখার জন্য ২০ টাকা করে নিচ্ছেন।

এস এম ইমরান শিশুদের বায়োস্কোপ খেলা দেখাচ্ছেন

দিন দিন পাল্টে গেছে গোটা বিশ্বের দৃশ্যপট। আধুনিককালে এই বায়োস্কোপ এখন বিলুপ্তের পথে। কেউ আর ডিজিটাল যুগে এসে এই বায়োস্কোপ দেখতে চায় না। এমনকি কেউ খোঁজ-খবরও নিচ্ছে না বায়োস্কওয়ালাদের।

লোকজ এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহবান ইমরানের। ইতিহাস বলছে, ১৮৯৮ সালে বঙ্গদেশে প্রথম বায়োস্কোপ দেখান হীরা লাল সেন নামে এক বাঙালি। পরবর্তীতে যিনি নির্মাণ করেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র।

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031