রকমারি

শৈশবের এক টুকরো আনন্দ ‘হাওয়াই মিঠাই’

-বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

ঘোরলাগা শৈশবের অলস দুপুরে কান পাতলেই দূর থেকে শোনা যেত, ‘মিঠাই লাগবে, হাওয়াই মিঠাই!’ হয়তো কোনও মাঝ বয়সী বা বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা টিনের বাক্সে (চারপাশে স্বচ্ছ কাচের দেয়াল দেওয়া) গোল গোল গোলাপি-সাদা রঙয়ের হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাক ডাক দিতে দিতে এসে হাজির হতো। এযেন এক টুকরো স্বপ্নের মতো বিষয় ছিল। পুরনো প্লাস্টিক, কাচের বোতল, লোহার জিনিসপত্র বা এক টাকা দিলেই পাওয়া যেত কয়েক টুকরো হাওয়াই মিঠাই। মুখে পুরে দিতেই এক অপূর্ব মিষ্টি স্বাদের স্বপ্নিল ছোঁয়া দিয়ে নিমিষেই মিলিয়ে যেত। এজন্যই এর নাম হাওয়াই মিঠাই। অনেকে মজা করে হাওয়াই মিঠাইকে বুড়ির মাথার পাকা চুলও বলেন। ইংরেজিতে রয়েছে এর কিছু মজাদার নাম; যেমন কটন ক্যান্ডি, ফেয়ারি ফ্লস, ক্যান্ডি ফ্লস কিংবা স্পুন সুগার।

হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার চাইতেও এর দেখার আকর্ষণটা কোনও অংশে কম নয়। পেজা তুলোর মতো তুলতুলে ও গোলাপি-সাদা রঙয়ের এই ঐতিহ্যবাহী হাওয়াই মিঠাই দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কালের পরিক্রমায় আজ সেই ছোট ছোট গোলাকার হাওয়াই মিঠাই আকারে ফুলে ফেঁপে বেশ বড় হয়েছে। কাঠিতে পেঁচিয়ে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় এখন সব জায়গায় পাওয়া যায়।

ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশে বিভিন্ন মেলা এবং গ্রামের পথে ঘাটে বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে দেখা পাওয়া যায় হাওয়াই মিঠাই ফেরিওয়ালাদের। পিতল বা কাঁসার ঘন্টায় টিং টিং শব্দ তুলে শিশু-কিশোরদের দৃষ্টি কাড়ে তারা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের ঘিরে ধরে শিশু কিশোরের দল।

বৈশাখ মাসের শুরুতেই পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, বিজু, সাংগ্রাই, বৈসাবিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মেলাতে দেখা যায় ছোট্ট একটি ঘরে হাওয়াই মিঠাই বানানোর ব্যস্ততা। কারিগরদের হাত চলছে সমানে। কেউ ঘোরাচ্ছেন হাওয়াই মেশিনের চাকা, কেউ প্যাকেট করছেন, কেউ মেশিন থেকে নামানো মিঠাইকে গোলাকৃতির রূপ দিচ্ছেন। এরপর পলিথিনে প্যাক করে সাজিয়ে ভরে রাখছেন কাচের বাক্সে।

হাওয়াই মিঠাই বানাতে খুব বেশি কিছু লাগে না। একটি মেশিন, আর উপকরণ হিসেবে স্পিরিট, চিনি, তেল আর হালকা ভোজনযোগ্য রঙ। চলন্ত মেশিনের উপরিভাগের থালার মতো জায়গার মধ্যে ছিদ্রতে দেওয়া হয় এই উপকরণ। মেশিনের ঘূর্ণিতে যে তাপ উৎপাদন হয় তা থেকে রূপ নেয় হাওয়াই মিঠাই। এক কেজি চিনি দিয়ে প্রায় ৫৫০ থেকে ৭০০ হাওয়াই মিঠাই বানানো যায়। বলছে উইকিপিডিয়া।

চৌদ্দ শতকে ইটালিতে চিনি দিয়ে তৈরি এই মজার খাবারটি প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় ঘরোয়াভাবেই সামান্য চিনির ঘন রস বিশেষ পদ্ধতিতে সুতোর মতো তৈরি করে বানানো হতো হাওয়াই মিঠাই। আঠারো শতক পর্যন্ত এভাবে তৈরি হয়েছে। ১৮৯৭ সালে মার্কিন উইলিয়ম মরিসন ও জন সি. ওয়ারটন হাওয়াই মিঠাই তৈরির জন্য প্রথম মেশিন আবিষ্কার করেন। এই মেশিনের সাহায্যে চিনির যে সুতো তৈরি হতে লাগল, সেগুলো আরও সূক্ষ্ম আর বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গেই শক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে তাড়াতাড়ি এটি তৈরি হয়ে যেত। তবে মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই তখন তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। ব্যাপকভাবে এর প্রসার বাড়ে ১৯০৪ সালে। সে বছর মরিসন এবং ওয়ারটন তাদের মেশিনে তৈরি হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাজির হলেন, সেন্ট লুইসের বিশ্ব মেলায়। অবাক হওয়ার বিষয়, মেলার প্রথম দিনই ২৫ সেন্ট করে ৬৮ হাজার ৬৫৫ বাক্স হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়েছিল, যা ছিল সে সময়ের হিসাবে অনেক বড় একটা অঙ্ক! ক্রমেই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। চাহিদা ও জনপ্রিয়তার জন্য একাধিক কোম্পানি এগিয়ে এল এই মজাদার খাবারটি উৎপাদন ও বিপণনে। টটসি রোল অফ কানাডা লিমিটেড বিশ্বের সর্বাধিক হাওয়াই মিঠাই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান।

দেখতে অনেকটা তুলার মতো বলে ১৯২০ সালে মার্কিনরা এই মিঠায়ের নাম দিয়েছে ‘কটন ক্যান্ডি।’ তারা এই হাওয়াই মিঠায়ের এতই ভক্ত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭ ডিসেম্বর দিনটি ‘জাতীয় কটন ক্যান্ডি ডে’ হিসাবে পালন করা হয়।

চিরায়ত বাংলার এই হাওয়াই মিঠাইয়ের ঐতিহ্য শৈশবের মতোই জ্বলজ্বল করে বেঁচে থাক।

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

March 2024
M T W T F S S
 123
45678910
11121314151617
18192021222324
25262728293031