ঋতুর সাজ

হেমন্ত বিকেলে মন দেই বিলিয়ে

মডেল: কাজী আল আমিন ও রোমানা আমিন

প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা

হ্যালোডেস্ক

কেলেণ্ডারের হিসেবে হেমন্ত আসার একটু আগেই প্রকৃতির দুয়ারে হেমন্ত এসে কড়া নাড়তে শুরু করলো I প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা |বাতাসে শীতের গন্ধে মন চনমন করে ওঠে |পূর্বে সারাটি বছর এই শীতকালের জন্যে অপেক্ষার প্রহর কাটতো |শীতে যতই কষ্ট হোক, কষ্ট মনে হয় না, গরম কালে যতটানা লাগে|রুমের পশ্চিমের জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস যখন আসে প্রাণ মন সব জুড়িয়ে যায়| এই সময়ে ব্যালকনির পশ্চিম-উত্তর কোনে দাড়ালে বাতাসে গ্রামের গন্ধ পাই| বুক ভরে শ্বাস নেই| খড়-মাটির মিশেল মাতাল করা সেই গন্ধে যে কী সুখ, কী যাদুকরি ভাললাগা সেটা কাউকে বোঝাতে না পারলেও নিজে ঠিকই উপভোগ করি|

বাংলার ষড়ঋতুর পালাবদলে আসছে হেমন্তকাল I এ সময়ে আকাশ সাজে নানা রূপে। কখনো নীলচে সাদা, কখনোবা গাঁয়ে সন্ধ্যার সোনারঙ মাখে। আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা।বাতাসে, রোদ্দুরে কেমন যেন একটা মিষ্টি ভাব লেগে থাকে সারাক্ষণ।বাংলাদেশের প্রকৃতির কত রূপ, কত বিভা | শিল্পীরা শ্যামল প্রকৃতির এই রূপকে ধরে রাখেন রং-তুলি-ক্যানভাসে, কখনো তেলরঙে, কখনো বা জলরঙে|

হেমন্তকে বলা হয় বৈচিত্রময় রঙের ঋতু। হেমন্তকাল হলো পাতা ঝরার দিন। হেমন্তে নব সাজে সেজে ওঠে পাহাড়ের অরণ্যে গাছপালা, যেনই তখন হয়ে ওঠে সর্বত্র সবুজের সমারোহ। এক সময় বাংলায় বছর শুরু হতো হেমন্ত দিয়ে। কারণ, ধান উৎপাদনের ঋতু হলো এই হেমন্ত। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে।আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পরিপক্ক হয়।এ ঋতুতে ফোটে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলি, কামিনী, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন,রাজ অশোক প্রভৃতি ।

পৃথিবীর আরেক প্রান্ত উত্তর আমেরিকার কানাডাতে হেমন্তের শুরু ২২ সেপ্টেম্বর থেকে|বেশ খানিকটা সময় ধরে হেমন্তকে নিয়ে লিখতে বসে মাথাটা কেমন যেন চেপে ধরেছে I একটু টাটকা হতে এক কাপ চা নিয়ে ব্যালকনে গেলাম | কনকনে মৃদু ঠান্ডা হওয়া বইছে I এ সময়টায় তাপমাত্রা মাঝারি থাকে I এ সময় টিপটিপ বৃষ্টি হয় | আমাদের দেশের মতো সারাদিন ঝর ঝর করে ঝরে না| খুবই থেমে থেমে এবং অনিয়মিত|কানাডায় ব্ল্যাক ফরেস্টের নানা ধরনের ঝাউ গাছগুলো ছাড়া আর সব গাছেরই পাতা এ সময় ঝরে যেতে শুরু করে এবং শীতের আগমনের আগেই সব বৃক্ষই ন্যাড়া হয়ে যায়। তবে এখনো মেপেল লিফ সহ প্রায় সব গাছের পাতাগুলো হলদে-তামাটে বর্ণ ধারণ করে বহাল তবিয়তে আছে কিছু গাছের পাতা |

নিশ্চয় বাংলাদেশে কুয়াশার চাদরে এখনো ঢাকেনি গ্রাম। এখনো শীতের আমেজে জবুথবু হয়নি শহরের মানুষ। কিন্তু গাঁয়ের ভোরের মেঠাপথে এখন কুয়াশার হিমশীতল পরশ। হেমন্তের শীতের পরশটা উপভোগ্য হয়ে ওঠে নবান্নেই। নতুন ধান ঘরে ওঠার আনন্দে এদিন কৃষাণ-কৃষাণিরা উদ্বেলিত হয় আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে। গ্রামবাংলায় অগ্রহায়ণের সকালের স্নিগ্ধতা জুড়িয়ে দেয় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার আপাদমস্তক। এ দিনের রাঙা সকালের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে গাঁয়ের কৃষাণ-কৃষাণিরা। নতুন ধানের আনন্দ নগর জীবনের নাগরিকদের সুখের আবেশ দিতে না পারলেও মাটির টানে নগরবাসীও মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে।

বাংলাদেশে নবান্ন উৎসব পালন করত প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়।বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের শিকড় থেকেই নবান্ন উৎসব প্রচলিত। হেমন্তের ধান কাটার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত অগ্রহায়ণ মাসে অনুষ্ঠেয় অন্ন খাওয়ার উৎসবই হল নবান্ন যা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নানা ধরনের দেশীয় নৃত্য, গান, বাজনাসহ আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পালিত হয়; লাঠিখেলা, বাউলগান, নাগরদোলা, বাঁশি, শখের চুড়ি, খৈ, মোয়ার পসরা বসে গ্রাম্য মেলায়। বর্তমানে সেসবের অনেক কিছুই লোপ পেয়েছে। এখন সংক্ষিপ্তভাবে কেউ কেউ এ উৎসব পালন করে ।

ছুটির দিনের বিকেল বেলা হেমন্তের স্মৃতি রোমন্থনে আপ্লুত হয়ে হেলাম|ডেন্টোনিয়া পার্কে বিকেলটা কাটানোর বাসনা জাগলো মনে । বাসা থেকে তা খুব দূরে নয়,পার্ক অব্দি পৌছতে সামান্য হাঁটার পথ। হাঁটতে হাঁটতে শীতের একটা হিমেল আমেজ পাওয়া যায়। ভালবাসার আগে যেমন ভাললাগা তেমনি শীতের আগের প্রায়শীতকে হেমন্ত মনে হয়| মুহুর্তে ভেসে উঠলো স্মৃতির পটে উঠানে ছেলেবেলাকার প্রভাতের শিশির সিক্ত শিউলি ফুল কুড়ানো একান্নবর্তী পরিবারের ভাই-বোনেরা মিলে। আহা! আফসোস, আফসোস। ভীষণভাবে মিস করি সেই স্বর্ণালী দিনগুলো।আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম বিকেলে, নীল সাদার সুষম কম্বিনেশন পুরো আকাশ জুড়ে |

শীতের তীব্রতা তাদের কুরে কুরে খেতে কেবল মাত্র শুরু করে ! এ সময় গ্রামে গ্রামে ধুম পড়ে যায় খেঁজুর রসের পিঠা আর সিন্নি বানানোর অঘোষিত প্রতিযোগিতা। চলে কৃষকের ঘরে নবান্ন বানানোর মহোত্সব। ছেলেমেয়ের কলকাকলি আর ধান মাড়াইয়ের শব্দে জেগে ওঠে সমস্ত পাড়াগাঁও। হাটুরে হাটে যান| ফেরিওয়ালা নানাবিধ পণ্য নিয়ে পথে যেতে যেতে হাঁক ছাড়েন, বাজান ঘণ্টি| দুধওয়ালা দুধে ভরা কলসি নিয়ে ছোটেন শহরের উদ্দেশ্যে| লোকজন নিয়ে গরুর কিংবা মহিষের গাড়ি ছোটে এ গ্রাম থেকে ভিন গাঁয়ে অথবা অন্য পথ প্রান্তরে। নৌপথে নববধূ চলেন নাওরে। তার দুচোখে ভাসে ফেলে আসা দিনগুলো, দুরন্ত শৈশব, কৈশোর, আর আগামীর স্বপ্ন! থেকে থেকে পরাণ মাঝি গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালী, মুরশিদি। সব মিলে ভালোলাগা দোল দিয়ে যায় আমার ছোট্ট অবুঝ মনে, আর তাই এ মনের ক্যানভাসে এঁকে যাই বাংলা মায়ের মুখছবি|তুলতুলে নরম হূদয়ের কড়িডোরে অহর্নিশি হাঁটে হেমন্তের মৃদুমৃদু পায়ে চলা। আমি মুগ্ধ, আমি ধন্য, বাংলার কোলে জন্ম নিয়ে|আর তাই নিজে নিজে গেয়ে উঠি:

“সোনার ধানের মধুর গন্ধ/আসলে হেমন্ত,
মেতে উঠে গ্রামবাসীরা/সুখের নেই অন্ত I
নবান্নের উত্সবে/জেগে উঠে পাড়া,
কৃষক শ্রমিক সবার মুখে/আনন্দেরই ধারা

Add Comment

Click here to post a comment

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930