আজকের দেশ

বাধভাঙ্গা আনন্দে উদযাপিত হলো পুরান ঢাকার সাকরাইন উৎসব

১৫ জানুয়ারি ২০২২


চারপাশ ভোরের হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এর মাঝে এক টুকরো রঙিন আকাশ। আর এই রঙিন আকাশে শত শত ঘুড়ি উড়ছে। সাকালের আলো ফোটার সাথে সাথেই প্রতিটি বাসার ছাদে উঠে জড়ো হতে থাকে অনেক মানুষ। সারাদিন আকাশের বুকে ওড়ে শত শত ঘুড়ি। দেখে মনে হয় এ যেন আকাশের বুকে এক ঘুড়ির মেলা। পৌষের শেষদিনটিতে এমনই উৎসবের রঙ এ সাজে ঢাকার খুব ছোট্ট একটা অংশ পুরান ঢাকা। আর উৎসবটির নাম পৌষ সংক্রান্তি, যা সাকরাইন। শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) পৌষ সংক্রান্তি, যা সাকরাইন উৎসব।

চৌদ্দ জানুয়ারি পৌষ মাসের শেষ দিন। পৌষ সংক্রান্তির এই দিনটিতে পালিত হয় পুরনো ঢাকাবাসীর ঐতিহ্যেবাহি সাকরাইন উৎসব।

ছোট বড় সকলের অংশগ্রহণে মুখরিত হয় প্রতিটি ভবনের ছাদ। সাকরাইন উদযাপনের জন্য আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই সকলে ভিড় জমায় পুরান ঢাকার শাখারি বাজারে। গভীর রাত অবধি সেখানে চলে ঘুড়ি বেচাকেনা।

সাকরাইনের এই দিনে, নানা রঙের বিচিত্র আকারের ঘুড়িতে যেন, রঙিন হয়ে ওঠে পুরনো ঢাকার আকাশ। প্রজাপতি, পঙ্খিরাজ, চুড়িদার, গাহেলদার, কাউঠাদার, চোখদার, চাঁনদার, ঘর গুড্ডি, বাক্স গুড্ডি, কয়রা ইত্যাদি নানারকমের ঘুড়ি খেলায় মেতে ওঠে স্থানীয় বাসিন্দারা। মাঞ্জা দেওয়া সূতা দিয়ে একজন আরেকজনের ঘুড়ি প্যাচ লাগিয়ে কাটাকাটি খেলায় মেতে ওঠে। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থ্যাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে দুরে মিলিয়ে যায়। তখন সবাই ঘুড়ি কাটার আনন্দে ভাকাট্রা বলে চিৎকার করে ওঠে।

এক দশক আগেও ছাদে ছাদে থাকতো মাইকের আধিপত্য। আজ মাইকের স্থান দখল করেছে আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম।

স্থানীয়দের পাশাপাশি দুর-দুরান্তের মানুষ, এমনকি ভিনদেশিরাও ছূটে আসেন এই উৎসবটি সচক্ষে দেখার জন্য। ঘুড়ি ওড়ানোর সাথে সাথে আগত অতিথিদের জন্য থাকে নানা ধরণের পিঠা পায়েসের আয়োজন।

সাকরাইন শব্দটি সংস্কৃতি শব্দ সংক্রন থেকে এসেছে। যার আভিধানিক অর্থ বিশেষ মুহুর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহুর্তকে কেন্দ্র করে যে উৎসব পালিত হয়,তাকেই বলা হচ্ছে সাকরাইন উৎসব।

এই উৎসব কবে থেকে শুরু হলো এর সঠিক তথ্য অজানা থাকলেও জনশ্রুতি আছে ১৭৪০ সালের দিকে নবাব নাজিম নওয়াজেস মোহাম্মদ খাঁনের সময় থেকে ঢাকায় ‘ঘুড়ি উড়ানো’ উৎসব প্রচলিত হয় এবং নবাব পরিবারের সদস্যগণ এ উৎসবের উৎসাহদাতা হিসেবে বিরাজ করতেন। সেই সময় ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ অভিজাত মহলের মধ্যই সীমাবদ্ধ ছিল- যা এখন সর্বসাধারনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

প্রাচীনকালে পুরান ঢাকায় সাকরাইন উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের নাটাই, বাহারি ঘুড়ি উপহার দেয়া এবং পিঠার ডালা পাঠানো ছিল অবশ্য পালনীয়।
আত্বীয়-স্বজন এবং পাড়ার লোকদের মধ্যে, নীরব প্রতিযোগিতা চলত, কার শ্বশুরবাড়ি হতে কত বড় ডালা এসেছে। এখন অবশ্য এই সব চমৎকার আচারগুলো বিলুপ্তির পথে। এখনো পুরনো ঢাকার আদি বসবাসকারীরা এই ঐতিহ্যগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করেন। নতুন প্রজন্মকে শোনান সেই সব মুখরিত দিনের কথা।

সন্ধ্যা ঘনাবার সাথে সাথে পুরনো ঢাকা সকল জঞ্জাল আর কালিমা পুড়িয়ে দিতে শুরু হয়, আগুন খেলা ফানুশ ওড়ানো। এছাড়া আতশবাজির ঝলকানিতে মুখরিত হয়ে পড়ে পুরনো ঢাকার আকাশ।

হালের পরিবর্তনে তরুন তরুনীরা মেতে ওঠে ডিজে পার্টিতে। বয়সের ভেদাভেদ ভুলে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ মেতে ওঠে আনন্দ উদযাপনে । পুরনো ঢাকার প্রতিটি বাড়ীর ছাদে রঙিন আলো এবং দ্রুত তালের লহরীতে গা ভাসিয়ে দেন ছোট বড় সকলেই। পুরান ঢাকার ঢাকার আথিতেয়তার টানে দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসে বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।

লেখক, আল মাসুম সবুজ
চিত্রসাংবাদিক

 

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

May 2025
M T W T F S S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031