অনু গল্প

চিতার আগুন

সাময়িকী : শুক্র ও শনিবার

০৫ নভেম্বর ২০২১


-মিলা মাহফুজা

চারপাশের বাড়ি থেকে পালাও পালাও চিৎকার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দের ভেতর ঘরে ঢুকে পৌঢ় বাবু মণ্ডল হাতের কাছে যা পেল সেগুলো পায়ের কাছে পড়ে থাকা বাজারের থলেতে ঠেসে দিয়েই কাঁখে তুলে নিল ছয় বছরের নাতী কাজলকে। হাতে গলিয়ে নিল ব্যাগটা। চৌকির উপর কেতরে পড়ে থাকা কাজলের মাকে কোমল গলায় ডাকল, অ মা, ওঠো।
পারুল উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কিসির হট্টোগোল হচ্ছে এ্যাতো?
-তুমি আমার হাতটা ধরে উঠে দাঁড়াও দিনি।
পারুল আবার- কারা চেচাচ্ছে অতো, অ্যা- বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায়। বাবু মণ্ডল তার বাহুর কাছটা ধরে বলে, চলো।
-কনে যাব?
-কতা কয়ো না, হাঁটো।
পারুল হাঁটে। উঠোন পার হয়েই ও পাড়ার আগুনের লকলকে শিখার দিকে চেয়ে আবার বলে, কী হচ্ছে গো, বাপু?
বাবু মণ্ডল উল্টো দিকে পারুলকে টেনে নিতে নিতে বলে, একটু পা চালিয়ে আয় মা।
পারুল ভারী পা ফেলে ফেলে হাঁটতে থাকে আর কিছু না বলে।
বিশু বিশ্বাসদের একদাগের বড় ভুঁই পার হয়েই পারুল বলে, আর পারছিনে গো বাপু।
বাবু মণ্ডল বলে, আর একটু চল।
কাজল দূরের আগুনের দিকে চেয়ে আছে কাঠ হয়ে। হাতের মুঠোয় বাবু মণ্ডলের মাথার কোনমতে টিকে থাকা চুলের গাছি। শক্ত করে ধরে আছে। সে এখন বলল, মা, অমলদের বাড়িতি আগুন লেগেছে। ওই দ্যাখো।
পারুল পিছন ফিরে চায়, আকাশের গায়ে আগুন ঝলসে ঝলসে উঠছে। সে হঠাৎ খানিক ছুটে এগোতে গিয়ে সামনের আমন ধানের ক্ষেতে পা হড়কে পড়ে গেলে আর রা কাঁড়ে না। বাবু মণ্ডল তাড়াতাড়ি কাজলকে নামিয়ে দিয়ে পারুলের কাছে যায়। পারুল মাটিতে শুয়ে ফোঁপাচ্ছে। বাবু মণ্ডল তার গায়ে হাত রাখলে সে বলে, কাজলের বাপরে বাড়ি আসতি না করেন, বাপু।
-তুই ঠিক আছিস মা? পেটে ব্যথা পাইসনি তো?
পারুল আবারও বলে, তারে মুবাইল করেন। তাড়াতাড়ি করেন।
একটু থেমে পারুল বলে, কাজলরে নিয়ে আপনি পালান।
বাবু মণ্ডল গামছায় মুখ মোছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এক ঢোক পানি খায়। পারুলের দিকে বোতলটা বাড়িয়ে দেয়। পারুল বোতল নিয়ে ঢকঢক করে অনেকটা পানি খায়।
পারুল ধীরে ধীরে উঠে বসে। তা দেখে বাবু মণ্ডল শ্বাস টানে বুক ভরে। ভরা পোয়াতি পারুল। দুদিনের টানা বৃষ্টিতে মাটি ভিজে নরম বলেই হয়ত বেশি চোট লাগেনি।
পারুল আবার বলে, তারে ফোন দেন, বাপু।
চুপ করে থাকে বাবু মণ্ডল। কাকে ফোন দেবে? চৌদ্দ পুরুষের মাছ ধরা কাজ ছেড়ে ইজিবাইক চালক হয়েছিল। ভাল রোজগারও করছিল। শহরে চলে যাওয়ার কথা বলছিল। পারুলের জন্যে যায়নি। গতকাল সকালে পুলিশের ফোন আসে। কোথায় কোন ডোবায় লাশ পড়েছিল। ইজিবাইক উধাও। বাবু মণ্ডল পারুলকে কিছু জানায়নি। লাশও আনতে যায়নি। পুলিশকে যাচ্ছি, যাব করে কাটিয়েছে।
কাজল ফিসফিস করে বলে, জাড় লাগছে।
বাবু মণ্ডল ব্যাগের ভেতর থেকে হাতড়ে একটা কাপড় বের করে ওর গায়ে জড়িয়ে দেয়। পারুলকে জিজ্ঞেস করে, চোট লাগিনি তো তোর?
পারুল বলে, মনে হয় পা মচকে গিয়েছে। কাজলরে নিয়ে আপনি পালান। এ পাড়ায় আগুন দিলি আমাদের দেখা যাবেনে পরিষ্কার। যান দিনি, বাপু। তারে একটা ফোন দেন। নায় আমারে দেন মুবাইল।
বাবু মণ্ডল বলে, তুমি ঠিক হয়ে বসো। আর কতা কয়ো না।
পারুল কথা বাড়াতে পারে না। সে কঁকাতে শুরু করে।
কার্তিকের হিম ঝরে পড়ে তিনটি মাথা বেয়ে মাটিতে। ও পাড়ার কোলাহল ক্ষীণ হতে থাকে। এ পাড়ার নিথর আট/দশটি বাড়ির দিকে তাকিয়ে বাবু মণ্ডল প্রাণপণে জেগে থাকে। কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়া নাতি কাজলকে আরও কিছু কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। পারুল একসময় নিশ্চুপ হয়। আরও পরে আকাশে আগুনের ঝলকানি কমে আসতে থাকে। দিনের আলো ফোটে যথা নিয়মে।
বাবু মণ্ডল ঘুমন্ত কাজলকে কোলে নিয়ে পারুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পারুল অতিকষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, কনে যাব? বাবু মণ্ডল কিছু বলে না। তখন তাদের ক্লান্ত নড়বড়ে চারটি পা ভেজা মাটিতে ছাপ ফেলে একের পর এক।
পারুলকে ঘরে রেখে রাস্তার দিকে এসে দাঁড়ায় বাবু মণ্ডল। ও পাড়ায় পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি থেকে এখনও ধোয়া উঠছে। পুলিশের নীল গাড়ির চারপাশে মানুষের জটলা।
বাবু মণ্ডল ঘরে ফিরে আসন্নপ্রসবা পুত্রবধূ আর নাতির জন্যে খুদের ভাত চাপায় চুলোয়।
আগুনের লকলকে শিখার দিকে তাকিয়ে বাবু মণ্ডলের মনে হয়- কাল কত আগুন হলো, অথচ তার ছেলেটা চিতার আগুন পায়নি এখনও!

Add Comment

Click here to post a comment

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031