জীবনমঞ্চ

মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে লচছে জীবন

-শ, বারী শিপন

(এক)
জীবন যুদ্ধে সংগ্রামরত এক অকুতোভয় যোদ্ধার নাম, আব্দস সামাদ। ৯২ বয়সেও হার মানেননি জীবন যুদ্ধে! এমনকি বিশ্বব্যাপী দাঁপিয়ে বেড়ানো করোনা ভাইরাসও তাকে দমাতে পারেনি! এখনো রোজ পাঁপড় নিয়ে চষে বেড়ান খুলনা শহরের ময়লা পোতা-শিববাড়ি মোড়- নিউমার্কেট -ডাকবাংলো রোড-রয়েলের মোড়-তুতপাড়া এলাকার অলিগলি।

প্রিয় পাঠক ও বন্ধুরা বমার সত্য এবং আমারই সাথে যেহেতু ঘটনার বিষয়বস্তু, তাই গল্প আকারে আপনাদের কিছুটা টাচ করানোর জন্য বিষদ বলছি।শোনেন,আমি সরকারী মালিকানাধীন একটা কোম্পানীতে হায়ারক্লাস লেবেলের একটা পোস্টে চাকুরি করিতো!

আমি হঠাৎ করেই চাকুরি সূত্রে বগুড়া থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলা পৌষের তীব্র শীতের সময়ে খুলনা বদলী হয়ে আসি।তাই প্রথম দিকে প্রায়শই শহরটির সাথে পরিচিত হতে বেশ ইতিউতি ঘুরেফিরে বেড়িয়েছি! টুকটাক জিনিসপত্র কেনা,মার্কেট চেনা,প্রসিদ্ধ সব খানাপিনার পসরাগুলো ঘুরে দেখা, চেনা ও স্বাধ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে।তো ক’দিনের মধ্যেই একসময়ের স্রোতস্বীনি রুপসার কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা মাঝারী সাইজের এই বন্দর নগরী খুলনা বিভাগীয় শহরটি নিয়ন্ত্রণে এলো।এর মাঝে কিছু স্মৃতি, কিছু লোকের সহিত আলাপ পরিচয় গড়ে উঠল।এমনই একজন এই ৯০ বছরের অশীতিপর বৃদ্ধ আঃ সামাদ(মুক্তিযোদ্ধা -কিন্তু কোন সনদ সংগ্রহের চেষ্টা কখনও করেননি,তার নিজের ইচ্ছে না করার কারনে)।কোন এক তীব্র শীতের সন্ধায় ময়লাপোতার মোড়ে কাফু’র চা- দোকানের পাশে এই বৃদ্ধের সাথে দেখা,ওনার বয়সী ওমন একজন বৃদ্ধের এমন শীতে (বেশ কয়েকটা পুরান,জীর্ন-শীর্ন শোয়েটার- জ্যাকেট পড়নে)দেখে,আমি কিছুটা হতবাক ও আহত হলাম, দু-চারটে কথা বিনিময় করে আমরা ড্রাইভার সহ তিনজন প্রায় ৫০/- টাকার পাপড় খেলাম এবং ৪ পিচ পলি করে সঙ্গে রাখলাম।কথা হলো।ওনাকেও চা খাওয়ালাম।

তারপর দেখা হবে বলে বিদায় নিলাম! তারপর থেকে যতবার খুলনা শহরে গিয়েছি বিভিন্ন দরকারে,আমার অবচেতন মন বৃদ্ধ টিকে খুঁজে ফিরেছে!!তার পর একদিন দুপুরে শিববাড়ি মোড়ে দ্বিতীয় বার আবিষ্কার করলাম তাকে।ওদিন ওনার মুভমেন্ট, শিডিউল এবং অন্যান্য সকল তথ্য জানলাম।নিজ বাড়ী সাতক্ষীরা জেলার আশাসুনি থানার কোন এক শিমুলতলি গ্রামে।স্ত্রী মারা গেছে ১১ বছর আগে কোন এক অজানা অসুখে।পোলাটা বিদেশে গিয়েছিল দালালের মাধ্যমে ২০০৭ সালে- আজও তার কোন খবর পায়নি, সেই শোকে বৃদ্ধের স্ত্রী শোকে কাতর হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে ২০১০ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে জীবন সঙ্গী আঃ সামাদ কে বড় দূঃসময়ে একাকী রেখে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।বৃদ্ধ বলে চলে,”তাতেও আমি কখনও ভাইঙ্গে পড়িনি,কান্নাকাটি করিনী,ক্যান,সগল কিছুই তো ঐ উপরওয়ালা করেন! উনি যা ভালো বোঝেন তাই করবেন,আমরা মানুষ তার কি হরতি পারি কন! কিন্তুক কষ্ট লাগে আমার মাইয়াডার জন্যি,আছিয়া, বিয়া দিছিলাম পাশের গ্রামের এক ছোয়ালের সাথে,ঢাহায় বলে কি পিলাসটিক ফ্যাকটারিতি কাম হরে,পরথম দিকি আমার মাইয়াডারে ভালই আদর যত্ন করত,কিন্তুক তারবাদে পোলাডা কেমন যানি পাইল্টে গেলো।বাড়ী আসেনা,মাইয়াডার কোন খরচ পাতিও পাঠায় না।এদিকে পুয়াতি মাইয়াডা আমার ঔসুত পাতি,আর পথ্যের কষ্টে ভারি অসূস্থ্য হয়ে পড়ল,সে অনেক কথা,বাপ হইয়া এ কি সহ্য করা যায় বাজান!! সহ্য করা যায় না, শেষমেশ নিয়ে আইলাম আমার কাছে,হাসপাতালে ভর্তি হইরা চিষ্টা করলাম মেলা দিন,শেষে ডাঃ কইল অপারশন করা লাগবি,হয় নাতি নয় মাইয়া,একজনরে বাঁচান যাবি, চাচা, কি করবেন? আমি কি কব,কন ওদিকে মাইয়া আমার যায়যায়…

(দুই)
কঠিন পরিছিতি(পরিস্থিতি) শেষে ডাঃ এর হাত দুইহান জড়ায় ধইরা কইলাম, স্যার, আপনাগো বিবেচনায় যা ভালো হয়,আর আল্লাহ পাক আমার কপালে যা লিখে রেখেছেন, আমি তার বেশী কিছু বলব না,আপনি করেন অপারেশন, দেন আমি সই করে দিচ্ছি কাগজে।তবে বাজান,আমার ঐ মাইয়াডা ছাড়া এই দুনিয়ায় আপন আর কেউ নাই!!! বাবা, আমি বড় অসহায়,বড় নিরুপায় মানুষ আমি!!! আপনি বেবেচনা কইরা যিডা ভাল হয় করেন।অপারশন হইল ৭ মাসে,বাচ্চাটা বাচান গেলো না,মাইয়াডার আমার ৩ দিন পর হুঁশ ফিরল,বাচ্চাটার কথা জিগাইয়া,ওরে কান্নাকাটি, বাজান!! সে কি দেহা যায়!! (বৃদ্ধের চোখ টলমল করে উঠেছে,এই প্রথম লক্ষ্য করলাম বৃদ্ধের চোখদিয়ে দরদর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে) পথ্যের অভাবে মেয়েডা আমার খুব দূর্বল হইয়া পড়ল,ভূগলো মেলাদিন।ওদিকে শুনলাম জামাই না কি ঢাহায় আর একখান বিয়া করছে।আছিয়া রে তালাক না দিয়াই।কন কি অমানুষ! তারপর থেইকা মাইয়াডারে নিয়া আমার জীবন কোনমতে এই পাপঁড় ফেরী করে চলছে।মাইয়াডা শুকনা পাপড় তেলে ভেঁজে পলিতে রাহে, আর আমি মাথায় করে এই টাউনির ভিতর বিককিরি করি!!! ওই মাইয়াডার জন্যিই আমার এ বেচেঁ থাকা,এই জীবনসংগ্রাম। ওর জন্যিই বুধায় (বোধহয়) আল্লাহ পাক আমারে এহনো বাঁচায় রাখছে! নয় কবে ওর মার আগেই তো আমার বিদায় নিবার কথা,তাইনা!!! তয় অনেকে আমার মেয়েডারে বাসার ঝি’ য়ের কাজের জন্যি কয়,মেলা নিয়ারা করে,আমি রাজি হই না,কহনো না।আমি কইচি শোন মা,সম্মানের সাথে বাঁচার চিষ্টা করবি,যেদিন দেখবি পারতিছিস না,আর কোন পথ নাই।সেদিন তওবা পইড়া, আল্লাহর কাছে মাফ চাইয়া বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবি,কিন্তুক অসৎ পথে যাবিনে!! তইলি তর এই বাপ তোরে কোনদিন ক্ষমা করবি নে,মনে রাহিস।ঘরে দুই শিসি ইন্দুর মারা বিষ রেটম (Ratom) কিনে রাখছি।দুইজনের জন্যি।তারপরেও আমার কোন রাগ নাই,বাজান! নাই কোন অভিমান।কি জন্যি কন, এইতো ভাল আছি,বেশ!! আলহামদুলিল্লাহ!! এহন শুধু শেষদিনের অপেক্ষা!!! শুধু আছিয়ার জন্যি চিন্তা হয়”!!!

তারপর থেকে প্রায় দিনই দেখা হতো আঃ সামাদের সাথে। আমি এক ধরনের তীব্র ব্যাকুলতা উপলব্ধি করতাম তার জন্য,আমি বিস্মিত হয়েছিলাম,হতবাক হয়ে যাই,একটা মানুষ,একটা পরিবার কিভাবে এতটা কস্ট,অভাব,মমান্তিক ঘটনাগুলোকে বুকে চেপে রেখে পথ চলতে পারে!! আমি কুকঁড়ে যাই,আমি নিবাক গয়ে ভাবি, খোদা,তুমি কি বোজাতে চাইছো,কি মহত্ত্ব লুকিয়ে রাখলে এই সামাদদের মাঝে!! এরাই কি তাহলে সক্রেটিস,নিউটন, আলেকজান্ডার, ফ্লেমিং আলঃনোবেল দের মতো কোন বৃহৎ, বিশাল ক্ষমতা দিয়ে রেখেছো?? যে এহেন জীবন নিয়েও কি অবলীলায় কি স্বাচ্ছন্দে, কি স্বাভাবিকতায় বেয়ে চলেছে পোকামাকড়ের মতো বেদনাবিধূর জীবনের সাম্পান!!!

বেয়ে চলেছে জীবনের বেদনাবিধূর সাম্পান!!????? বলো,হে পরমেশ্বর, তুমি মোদের বুঝবার শক্তি দাও,সক্ষমতা দাও,সামাদ চাচার মতো অনেক কষ্ট,আর নির্মমতা বইবার শক্তি দাও।আমি প্রার্থনা করছি, আমাকে সেই সামর্থ্য দাও।একবার বয়ে দেখি, সেই ভার বহন করার মতো বড় কেউ সত্যিই কি হতে পেরেছি ?

আমি খুলনা শহরে ঢুকলেই সম্ভাব্য- স্পটগুলোতে একটা রাউন্ড দিতেই কোন না কোন স্পটে তাকে পেতাম।কথা হত,একসাথে চা খেতাম,আরো কিছু জানার চেষ্টা করতাম।কথা শেষে সামাদ চাচা তখন পাঁপড় নিয়ে বের হতেন ব্যবসায়। ওনাকে দেখে যে কারোই মায়া লাগবে! এভাবে মাঝেমধ্যে সালাম বিনিময় ও টুকটাক কথা হতো। ভদ্রলোক অভাবী হলেও সাংঘাতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। আর্থিক সহযোগিতার কথা বললে বলেন- “যে হাতে অস্ত্র চালিয়ে দেশ স্বাধীন করেছি সে হাতে ভিক্ষা করবো না বাজান “। আমি কারো দয়াও চাই না। এই বেশ ভালো আছি।

ওনার কথা শুনে আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। বিরবির করে বলি, শাবাশ ব্যাটা! মনে মনে স্যালুট জানাই। একদিন বললাম, কাকা আপনাকে নিয়ে পত্রিকায় একটা লেখা দিতে চাই।কাকা একগাল হেসে বললেন, লেখেন।

তারপর করোনা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়! লেখাটা রেডি হয়েছে। গত ১৪ মার্চ সাপ্তাহিক রুপসা কাগজের প্রিয়জন পাতায় আসার কথা থাকলেও আর হয়ে ওঠেনি। পাঠক পাতাটা আপাতত বন্ধ।

মনে মনে কয়েকদিন যাবৎ খুঁজছি কাকারে। গতকাল হঠাৎ ময়লা পোতা মোড়ে সাজন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে দেখা। পাঁপড় নিয়ে যবুথবু হয়ে বসে আছেন। আমরা এই তাগড়া শরীরেও এখন ঘরের কোনায় পালিয়ে থেকে যুদ্ধ করছি, আর কাকা পেটের তাগিদে রোজ মাঠে করোনাকে তাড়িয়ে বেরাচ্ছে!

বললাম, আরে কাকা! মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন ও আপনি!আমারে লেহা দ্যাহালেন না! বললাম,সরি কাকা, করোনায় পাতাটা আটকে গেছে। পাবেন শিগ্রী। ক্যামন আছেন জানতে চাইলে মুখটা ফ্যাকাশে করে বলেন, আছি বাজান কোন রহম! শরীরটা দুইদিন যাবৎ ভালো যাতেছে না।

মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগলো। মানিব্যাগ থেকে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে হাতের মধ্যে গুঁজে দিলাম। ইতস্তত করে নোটটা টান টান করে হাতে মেলে ধরে দু’ফোটা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললেন, আল্লায় আপনার ভালো করুক বাজান !

আমার খুব উপকার হবি নে! আল্লাহ আপনের ভালো করুক! বাজান!বলে পূবদিকের গলি লক্ষ করে এগিয়ে গেলো,কিছুক্ষণ পরে ভেসে আসল সেই পরিচিত হাঁক-” পাপঁড় খান,পাপঁড়,মচমচা ভাজা,ভালো পাপঁড় খান,পাপঁড়… ক্রমশঃ শব্দগুলো মিলিয়ে গেল হাওয়ায়,বৃদ্ধ ও অদৃশ্য হলেো দৃষ্টির সীমানা থেকে।

ছবি: লেখক

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031