রকমারি

যতবার যাই, ফিরে আসি যতবার

আজ ‘বিশ্ব বাবা দিবস’

-রেহানা বীথি

ছোটবেলার এক বন্ধুকে দেখেছি, তার বাবার সামনে কেমন একটা ভয় এবং গুটানো আচরণ। অবাক হতাম। কারণ আমাদের বাড়িতে একেবারে ভিন্ন পরিবেশ। আমরা দুই বোন সবসময় আব্বার সাথে যেভাবে সব কথা বলতাম, আম্মার সাথে তুলনামূলক কম। এজন্য আম্মা মাঝে মাঝে অভিমানও করতেন। বলতেন,
“তোদের মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, কখন কি প্রয়োজন সবই তো তোদের আব্বার কাছ থেকে জানতে হয়, আমাকে বললে কি সমস্যা?”

আম্মার অভিমানে আমরা দুইবোন খুব মজা পেতাম, আব্বাও। চারজনের খুব সহজ আর ভালোবাসায় ভরা একটা পরিবার আমাদের। আম্মা সংসারের কাজ করে ক্লান্ত হয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়তেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু আব্বা রাতজেগে বসে থাকতেন আমাদের কাছে। রিটায়ারমেন্টের পর সেটা আরও বেড়ে যায়। যতক্ষণ বই থাকতো আমাদের সামনে, চা কিংবা আর কিছু খাবো কিনা, সেই নিয়ে ব্যস্ত হতেন আব্বা। মাঝে মাঝে আমরা বলতাম,

“ঘুমিয়ে পড়েন তো আব্বা, কিছু লাগলে আমরাই নিয়ে নেবো।”
আব্বা শুনতেন না, বসেই থাকতেন আমাদের কাছে। ঘুমের চেয়ে আমাদের কাছে বসে থাকাতেই নাকি তাঁর বেশি আনন্দ। যখন ঘুমোতাম আমরা, বার বার এসে দেখে যেতেন, মশারি ঠিকঠাক গোঁজা হয়েছে তো? মশা না আবার তাঁর ঘুমন্ত মেয়েদের বিরক্ত করে বসে!

একসময় এক এক করে তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। আমার শ্বশুরবাড়িটা পুরোনো আমলের বাড়ি। উঠোন, পানির জন্য টিউবওয়েল চাপচাপি, ঘর থেকে বেশ অনেকটা দূরে বাথরুম, এসব নিয়ে তখন তাঁর দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। মেয়ে তাঁর পারবে তো সহজ হতে? যদি টিউবওয়েল চাপতে গিয়ে হাতল ছিটকে এসে আঘাত করে চোখেমুখে! কিংবা খড়ির চুলায় রান্না করতে গিয়ে যদি ঘটে যায় কোনও অঘটন! প্রায় রাতেই নাকি স্বপ্নে এটা ওটা দেখে জেগে যেতেন। বাকি রাত কাটতো দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম। সকালেই ফোন,
“ব্যাটা, ভালো আছো তো?”

এখনও উদগ্রীব থাকেন সবসময়। তাঁর দুই মেয়ের কোথাও কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো! যেন এতটুকু আঁচ লাগতে দেবেন না মেয়েদের গায়ে। কী এক অদ্ভুত ভালোবাসা! বার্ধক্যজনিত কারণে সেই তিনি নেই আর আগের মতো। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, কথা অসংলগ্ন, স্মৃতিগুলোও ঝাপসা অনেকটাই, তবু দুই মেয়ের জন্য উৎকণ্ঠার এতটুকুও হেরফের হয়নি। দুই মেয়ের সমস্ত স্মৃতি খুব সযতনে আগলে রেখেছেন বুকের গভীরে। সেই স্মৃতির অস্তিত্বই যেন খুঁজে পান তাঁরই উত্তরসূরী তাঁর তিন নাতনির মাঝে। একই রকমভাবে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চান তাদেরকেও।

যতবার যাই, ফিরে আসি যতবার, বয়সের ভারে ন্যুজ শরীর নিয়ে উঠে আসেন সদর দরজায়। অপলক চেয়ে থাকেন আমার চলে আসার পথটির দিকে। ততক্ষণ… যতক্ষণ আমার ছায়াটুকু ধুলো ওড়ায় ও-পথে।

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

September 2024
M T W T F S S
 1
2345678
9101112131415
16171819202122
23242526272829
30