গল্প

রুপোর বাক্স

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-বেনিন স্নিগ্ধা

ফজরের নামাজ পড়ে জমির তার ঘরের দরজা খুললো। বাইরের কালো ঘোলাটে রং পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। চৌকাঠ পেরিয়ে এসে উঠোনে পেতে রাখা বেতের মোড়াটায় জমির বসলো। বাড়ির সামনে শান বাঁধানো বিশাল পুকুর ঘাট। ঘাটের ঠিক ডান পাশে বড় বট গাছটা যেন তখনো তার ছায়ায় পুকুরটাকে জড়িয়ে রেখেছে।
জমির উদ্দিনের বয়স ৩৬। বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম। জমিররা ৩ ভাই। সে বড়। মেজ ভাই শহরে মামার মুদি দোকানে চাকরি করে। কালে ভদ্রে গ্রামে আসে বছরে ২/৩ বার। অবশ্য উপায়ও নেই। মামার দোকানের সব দায়িত্ব সে ই পালন করে। ছোট ভাইটা সেখানে মাদ্রাসাতে থেকে লেখাপড়া করে। ভালো ছাত্র হিসেবে মাদ্রাসায় তার খুব সুনামও আছে। পাশাপাশি সে একটা চায়ের দোকানে বিকেলে কাজ করে। এতে কিছু আয় রোজগারও হয়।

জমিরের বয়স যখন ১৭, তখন তার বাবা মারা যায়। তাকে সংসারের হাল ধরতে হয় তখনই। ছোট ভাইদের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য বাবা যে মসজিদে ইমামতি করতেন সেখানে তার একটা চাকরি হয়ে যায়। এ চাকরিটা তখন তার আয়ের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। বাবার জমি জিরাত তেমন ছিলোনা। তবে যতোটুকুই ছিল, বর্গা দিয়ে ওগুলো চাষবাষ করে টানাটানির সংসার চলে কোনমতে।

জমিরের বয়স যখন ২২, তখন সে বিয়ে করে। ২ বছর পর তার ঘরে এলো দুটি যমজ কন্যা সন্তান। অভাবের সংসার। কী করে চলবে? তার উপর ভাইদের লেখাপড়ার খরচ। মেজটাকে পাঠিয়ে দিল ঢাকায় কাজের আশায়। ঢাকায় গিয়ে অল্প ক’দিনেই ভুলে যায় গ্রামে ফেলে আসা ভাইদের। কিন্তু মাস গেলে ঠিকই টাকাটা পাঠিয়ে দেয় সংসার খরচ চালানোর জন্য। ভালো লেখাপড়ার জন্য ছোট ভাইটাকেও ঢাকা শহরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়।

জমিরের সংসার বড় হতে শুরু করলো। এক সময় সংসার খরচ আরও বেড়ে গেলো। জমির এবার সিদ্বান্ত নেয় সে ঢাকায় যাবে। প্রতিবেশী আলাউদ্দিন ঢাকায় মস্ত বড় চাকুরী করে। যদিও সেটা পিওনের চাকরি। কিন্তু বেতন ছাড়াও ফুটফরমায়েশি করে উপরি আয় হয় ভালোই। আলাউদ্দিন বলে, ‘ঢাকা হলো টাকার শহর, এখানে আসলে শুধু টাকাই দেখা যায়’। জমির মসজিদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আর জমানো কিছু সঞ্চয় নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমায়। আলাউদ্দিনই তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ৩ দিন পর জমিরের চাকরি হয়ে যায়। আলাউদ্দিনের বসের বাসায়। কেয়ার টেকারের চাকরি। থাকা, খাওয়া ফ্রি, মাসে ৪ হাজার টাকা বেতন।
দোতলা বাড়ি। বাসায় ৬ জন মানুষ। বাড়ির প্রধান হলেন গিন্নী মা। বয়স ৯৬ বড়জোর ৯৭। চোখে খুব ভালো দেখতে পান। চশমা ছাড়াই সূচিকর্ম করেন। কিন্তু হাঁটুর ব্যাথার জন্য কোথাও বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। আজকাল ব্যাথাটা বড্ড বেড়েছে। জমিরের মূল দায়িত্ব উনার দেখাশুনা করা। জমিরকে উনি একটু বেশিই ভালোবাসেন। কারণ সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।

গিন্নী মা’র চোখে কেমন যেন একটা চাপা ক্ষোভ আছে। কখনও সেই ক্ষোভের কথা কেউ জানতে পারেনি। চোখের ভাষা কঠিন হলেও মনটা কিন্তু নরম। বাড়ির সবাই তাকে ভয় পায় বটে কিন্তু শ্রদ্ধাও করে।
গিন্নী মা’র একটা রুপোর বাক্স আছে। এটা নাকি তার দাদী শাশুড়ি তাকে দিয়েছিলো। হাতে টাকা পয়সা এলেই সেগুলো নিয়ে তুলে রাখতেন তার সেই রুপোর বাক্সে। জমির গিন্নী মা’র দেখভাল করতো বলে সে জানতো, তার গিন্নী মা টাকা পয়সা কোথায় গুছিয়ে রাখেন। অবশ্য বড় অঙ্কের টাকা হলে সেগুলো ব্যাংকে জমা দিতেন, কাউকে দিয়ে।

এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন গিন্নী মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়িতে ডাক্তার ডেকে আনা হলো। সবাই গিন্নী মা’র জন্য চিন্তিত। ডাক্তার দেখে টেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। আর এও বললেন, ‘খুব বেশি সময় হাতে নেই’। জমির, ডাক্তারের শেষ কথাটা স্পষ্টই শুনতে পেয়েছিল। ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন আর ব্যাগ হাতে নিয়ে, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো জমির। বাইরে থেকে ঔষধ কিনে এনে গিন্নী মা’র ঘরে রেখে দিল। আর বিছানার পাশে রাখা সাইড টেবিলে কিছু শুকনো খেজুর আর এক গ্লাস পানি ঢেকে রাখলো।
রাত বাড়তে না বাড়তেই গিন্নী মা’র অবস্থর অবনতি হলো। তখন সবাই যার যার ঘরে নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। জমির বুঝতে পেরেছিল গিন্নী মা হয়তো আর বেশিক্ষণ নেই। সত্যিই তাই হলো। গিন্নী মা মারা গেলেন। জমির একবার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখলো, ‘না, নিশ্বাস নেই’। চোখ দু’টো আধো বোজা। তখনও বাড়ির কেউ টের পায়নি গিন্নী মা মারা গেছেন।
হঠাৎ কোনো এক অজানা কারণে গিন্নী মা’র তুলে রাখা রুপোর বাক্সের কথা মনে পড়ে যায়। বাক্সের চাবিটা থাকতো বালিশের ঠিক নিচে। আর বাক্সটা রাখা ছিল ড্রেসিং টেবিলের ২ নং ড্রয়ারের বাঁ দিকটাতে। জমিরের পূর্ব পুরুষদের কারও কখনও চুরির ইতিহাস ছিল না। গ্রামে তাদেরকে সৎ, মুসলিম পরিবার হিসেবেই গণ্য করা হতো। অভাবের কারণে তাদের পেশা বদল করতে হয়েছে।

বালিশের নিচে হাত দিতেই জমির এক গোছা চাবি পেয়ে গেলো। দেরি না করে সে চাবি হাতে সোজা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে রুপোর বাক্স বের করলো। বাক্সে সবগুলোই ৫০০ টাকার নোট। এদিক ওদিক তাকিয়ে জমির মুঠো ভর্তি করে টাকাগুলো পাঞ্জাবির এক পকেটে ভরতে লাগলো। এক পকেটে জায়গা হচ্ছিল না বলে সে আর এক পকেটে টাকা ভর্তি করে খালি বাক্স আগের জায়গায় রেখে দিল।

দ্রুত গিন্নী মা’র ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল সে। তখনও সে জানেনা তার পকেটে কত টাকা ভরেছে। মাথার উপরের ফ্যান ছেড়ে সে বিছানার উপর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। রাত বাড়ছে। ফ্যান এতো স্পিডে ঘুরছে, তারপরও জমির ঘামছে। কিছুক্ষণ পর ফজরের আজান শোনা গেল। জমির ওযূ করে নামাজ পড়ে নেয়। ভোরের আলো বেরিয়ে এসেছে। ততক্ষণে বাসার সবাই জেনে গিয়েছে মৃত্যুর খবর।

বাসায় তখন জমির ছাড়া কেউ নেই। ড্রাইভার আসবে কিছুক্ষণ পর।জমির গিন্নী মা’র ঘরে গিয়ে টাকাগুলো আবার রুপোর বাক্সে রেখে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে। তারপর কাপড় গুছিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পথে ড্রাইভারের সাথে দেখা হলেও কথা হয়নি তাদের। পথিমধ্যে একটা হোটেলে দু’টা বিস্কুট আর এক গ্লাস পানি খেয়ে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। সে যখন বাড়িতে পৌঁছুলো তখন প্রায় সন্ধ্যা। বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেই জমির দেখলো বট গাছের নিচে ভরাট চাঁদের আলোয় পুকুরের পানি জ্বলজ্বল করছে।

Add Comment

Click here to post a comment

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031