গল্প

শহরজুড়ে প্রজাপতি

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

– চিরশ্রী দেবনাথ (আগরতলা,পশ্চিমবঙ্গ)

সাড়ে ছটা। মর্নিংওয়াক। জনমেজয় চক্রবর্তী। বাষট্টি বছর। সুঠাম দেহ। গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা। রোদে পোড়া গায়ের রঙ, আরো ভালো লাগে দেখতে।
দেড়তলা, গোলাপী বাড়ি। সবুজ লন।

বাড়ি থেকে বেরোলেই ছটি ছেলে মেয়ে। পালতোলা, উচ্ছৃঙ্খল নৌকা যেন। জনমেজয়বাবুর তাই মনে হয়। কোচিং সেন্টারে যায় পড়তে। তিনি তাদের পেছন পেছন হাঁটেন। দেখেন। বিরক্ত হোন। সব বাঁধন শেষ। কোথায় যাচ্ছে সমাজ। কোঁকড়ানো চুলের ছেলেটি, সহপাঠিনীর ঘাড়ে হাত রেখে দিব্যি যাচ্ছে, যেন দুজন মেয়ে বা ছেলে। আরে তোরা তো একজন মেয়ে আর একজন ছেলে! আগে পিছে হাঁট। না, হাতে হাত, ঘাড়ে ঘাড়। হি হি হি। টাইট জিনস। গেঞ্জী। মেয়েগুলোর কি হয়েছে। আর কোন ধরনের জামাকাপড় নেই বাজারে? আশ্চর্য! কি শেখাচ্ছে এদের মা বাবা। পড়াশুনা করে নাকি এরা? মনে হয় না। পাড়া ভর্তি হয়ে যাচ্ছে এইসব বাজে ছেলেমেয়েতে। ড্রাগ এডিক্টেড নয় তো! সেরেছে! কোথায় জানি ঠেক এদের। নাহ্ একটা কিছু করতে হবে। এতো বছর এ পাড়ায়, এ শহরে আছেন এখন কোথা থেকে গজাচ্ছে এসব ছেলেমেয়ে।
হয়তো তারা ফ্রি সেক্সও ছড়াচ্ছে।

নিজেদের মধ্যে তন্ময় হয়ে হাঁটছে। রাস্তায় যেন আর
কোন মানুষ নেই। কাছে যেতেই কানে এলো একটি মেয়ে গুণগুণ গাইছে। হঠাৎ মনে হলো রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর, ঐ সুর নয়, রিমেক বোধহয়। আবার রবিবাবুকে নিয়েও টানাটানি।

পরের দিন ভোর। আজও বেরিয়েছেন তিনি, শরীরটা ভালো নয়। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। ঠান্ডা ভোর। এতসকালে না বেরোলেই হতো। ঐ তো সামনে ছেলে মেয়েগুলো। ঝোলা কাঁধে, স্যারের বাড়ি যাচ্ছে বোধহয়। সেই একই ভঙ্গি, যেন বিষাক্ত পোকামাকড়।
হঠাৎ চোখে অন্ধকার দেখলেন, মাথা ঘুরছে বনবন। তীব্র কোন আলো জ্বলে উঠলো কোথাও। আর কিছু বলতে পারেন না।
অনেক দূর থেকে কারা যেন ডাকছে আঙ্কেল আঙ্কেল। চোখ খুললেন, গভীর ঘুম থেকে মনে হলো জেগে উঠছেন, সামনে কতগুলো ফুলের মতো মুখ, পাশে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন।

একটুসময় বাদে বুঝতে পারলেন তিনি শহরের নামকরা নার্সিং হোমের বেডে শুয়ে। কি হয়েছিল তার, স্ট্রোক না হার্ট অ্যাটাক! হঠাৎ একটি রিনরিনে কন্ঠ কানে এলো, আঙ্কেল ডোন্ট ও্যরি, তোমার সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল খুব কমে গিয়েছিল, তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে, ডাক্তার আঙ্কেল বলেছেন রেস্ট, ঘুমনো, সামান্য মেডিসিন আর হালকা খাওয়া দাওয়া, তাহলেই আবার মর্ণিংওয়াক, সবকিছু করতে পারবে। আরেকটি সদ্য গোঁফ গজানো রোগা ছেলে বলল, তোমার হোয়াটস এপ আছে? থাকলে নাম্বার দিও, মাঝে মাঝে কথা বলবো, তোমাকে আমার বড্ডো ভালো লাগে।

এবার তার স্ত্রী বললেন, তুমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর, এরাই তোমাকে নার্সিংহোমে নিয়ে এসেছে, তোমার মোবাইল থেকে ফোন করে আমাদের কন্টাক্ট নাম্বার বের করেছে, তারপর তো আমরা এলাম।
দুদিন হয়ে গেলো, আজ নার্সিং হোম থেকে ছুটি পাবেন। শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করছেন, কিন্তু কেমন যেন খালি খালি লাগছে। হঠাৎ কয়েকটি হালকা পায়ের শব্দ, হ্যালো গুডমর্ণিং আঙ্কেল, কেমন আছো, সেই কচি কচি হাসি মুখ, ফাটা জিনস্, টাইট গেঞ্জীর ছেলেমেয়ে গুলো। জনমেজয় বাবু হাসলেন। ওরা এক ঝুড়ি টগবগে মৌসাম্বী নিয়ে এসেছে। জনমেজয় বাবুর স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলল, মৌসাম্বীর
রস খুব তাড়াতাড়ি সোডিয়াম পটাশিয়াম লেভেল ঠিক করে, আঙ্কেলকে দিও, আমরা আমাদের পকেট মানি থেকে এনেছি, সামান্য গিফট।
তাঁর স্ত্রী হেসে বললেন তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইলো, মাটন
বিরিয়ানি আর আইসক্রিম, জানাবো, আসবে অবশ্যই।
জনমেজয়বাবু কিছুই বলতে পারলেন না, তার গলা বুজে এসেছে, চোখে জল। ওরা বলল, যাই আমরা, আমাদের কোচিং আছে, আসব সবাই। দুরদার করে চলে যাচ্ছে হরিণের মতো পা গুলো।

জনমেজয় বাবু দেখছেন, এই ছেলেমেয়েদের দুকাঁধে গজিয়েছে প্রজাপতির পাখা, তারা সবাই উড়ছে, শহরময় ছড়িয়ে পড়ছে শুধু রঙবেরঙের প্রজাপতি, তিনি তাদের সঙ্গে খেলছেন, আর শহর থেকে হারিয়ে গেছে বিষাক্ত পোকার দল, কোথায় কে জানে!

Add Comment

Click here to post a comment

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

October 2024
M T W T F S S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
28293031