গল্প

স্মার্ট

সাময়িকী: শুক্র ও শনিবার

-শাহীন কামাল

‘স্যার, আপনি স্মার্টটা দেখতে পারেন। বেশ ভাল হবে আপনার জন্য’।
কিছুটা চমকে গেলাম মেয়েটার কথা শুনে৷ হাসি দিয়ে মেয়েটি আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক তার উল্টো দিকে নির্দেশ করলো হাতের ইশারায়। মেয়েটি নিজেই বেশ স্মার্ট। বেশ পরিপাটি। গলায় ঝুলানো নীল রঙের ফিতায় কার্ড ঝোলানো। অনেক মানুষের মধ্যে তার পোশাক আর গলায় ঝোলানো কার্ড তার পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘এ দিকটায় আসেন’। কথার সাথে হাসির কম্বিনেশনটা বেশ সুন্দর।
স্মার্টের গুণাগুণ বুঝাতে লাগল সে। আমি তার লেকচারটা ভাল করে আয়ত্ব না করতে পারলেও লেকচারের ধরণটা অবলোকন করছি। খুব গুছিয়ে কথা বলে মেয়েটি। এ বিষয়ে সে যে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত তা বুঝতে পারছি।
তা, আনস্মার্টও আছে নাকি আপনাদের? আমাকে ওটাও একটু দেখান তো, আমি বললাম।
‘ না, ঠিক আনস্মার্ট নয়,…..

কিছুটা হতচকিত হলো মনে হয়। এমন আনস্মার্টের প্রসঙ্গ সামনে চলে আসবে আশা করেনি সম্ভবত। মুখের হাসির রেখাটা সামান্য সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেও আবার ফিরে এসেছে। জোর করে হাসির সাথে হৃদয়নিঃসৃত স্বতঃস্ফূর্ত হাসির যে স্পষ্টত পার্থক্য আছে তা ভালভাবেই অনুধাবন করা যায়। বাহ্যিক প্রয়োজনে হাসিতে শুধু মুখ হাসে, অন্তরের উপস্থিত সেখানে শতভাগ অনুপস্থিত। সত্যিকারের হাসির রেখায় হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতির প্রকাশ থাকে ষোল আনা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গিয়ে ফিরে আসার মতো হাসি বলে দিয়েছে, সে মনে মনে বলেছে, এই সকল আনস্মার্ট লোকজন যে কোত্থেকে আসে!

দাঁত কিঞ্চিৎ বের করে, এদিক টায় আসুন, বলেই আমাকে অন্য রো তে নিয়ে যায় সে।
মনে মনে ভাবছিলাম, বেশ কয়েক বছর আগের বিশাল মাপের ভুড়িওয়ালা কিছু দেখাবে যার পশ্চাদাংশ বেশখানিক জায়গা দখল করে আছে। অনেকটা বিশালদেহী কেউ উদাম-দিগম্বর হয়ে হাত পা ছড়িয়ে বড় থালায় হপ হপ করে ভাতের লোকমা মুখে দেয়ার মতো হবে। অনেকখানি জায়গা দখল করা সেগুলোর পরিবর্তে বর্তমানে স্লিম হয়ে বেশ রামরাজত্ব করেছে বাজারে। আমাকে তাহলে কেন সেই পুরোনোর কাছে নিয়ে যাচ্ছে?
‘এটার কথা বলছি! এটাও দেখতে পারেন।’
আমি বললাম, দেখতে তো একই রকম। তবে আনস্মার্ট হলো কিভাবে?
আমার কথার কোন উত্তর না দিয়েই বলল, দামে সাশ্রয়ী, চাইলে এটা নিতে পারেন। আর যদি আরো ভাল চান, তবে এইগুলোও নিতে পারেন। অন্য পাশে আংগুলের নির্দেশনা করে বলল, এটাই এখন লেটেস্ট! কয়দিন আগেই বাজারে এলো। স্মার্ট থেকেও ভাল।
স্মার্ট থেকেও ভাল? বাহ! দারুণ তো! স্মার্টও ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে? পোস্ট স্মার্ট?- আমি বললাম।
সে তার মত কথা শুরু করেছে। মুখস্থ লেকচার। শিখানো বুলি। ময়নাকে মানুষ যেভাবে শিখায় সেভাবে। আমি যেন কিছুই বলিনি।
খুব করে ট্রাডিশনাল, স্মার্ট, পোস্ট স্মার্টের পার্থক্য অনুভব করার চেষ্টা করলাম। তিনটার দিকে ঘুরে ফিরে দেখলাম। বাহ্যিক অবয়বে পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়ে বললাম, তিনটাকে দেখতে তো একই রকম। পার্থক্য কোথায়?
দেখতে এক রকম হলেই কি এক? ফাংশনে এটি অনেক আলাদা, একটির দিকে আংগুল তুলে দেখালো মেয়েটি।
পাশের ছেলেটার দিকে চোখ আটকে গেল হঠাৎ করে। বিশ বাইশ বছরের ছেলেটির পরনের জিন্স বেশ কয়েক জায়গায় ছিদ্র। রঙ উঠা জিন্সটা অনেক আগেই কেউ হয়তো ফেলে দিয়েছে। চোখ তার আটকে আছে অন্য এক প্রোডাক্টের উপর। লাখ টাকা দামের টিভির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টি। চুলগুলো এলোমেলো ছেলেটার যেন কতদিন চিরুনির ছোঁয়া পায়নি চুল। ঢোকার সময় টাকা চাওয়া ছেরা প্যান্ট পরা ছেলেটার সাথে এই ছেলেটার পার্থক্য খুঁজছি।

‘ এটা কী স্মার্ট? নাকি পোস্ট স্মার্ট?” ছেলেটার ছেড়া প্যান্টের ফুটো দেখতে দেখতে আনমনে বললাম।
হ্যাঁ, বলেই সে আমার দিকে তাকালো। আমার চোখ ততক্ষণে ছিদ্র অন্বেষণ থেকে তার দিকে ফিরল।
‘ এখন সবাই এটা পছন্দ করে’ আমাকে অন্যমনা দেখে সে আবার বলে উঠলো। চোখে চোখ পরতেই সে এবার হেসে উঠলো। এ হাসিতে কোন লৌকিকতা নেই, সহজাত হাসি।
‘এই তাহলে স্মার্ট! বাহির দেখে মূল্যায়ন ঠিক নয়। ভেতরটাই আসল’, আমি বললাম।
কি বুঝলো তা বোঝার আগেই আমি কাউন্টারে চলে গেলাম।

Add Comment

Click here to post a comment

ফেসবুক পেজ

আর্কাইভ

ক্যালেন্ডার

April 2024
M T W T F S S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930